
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সিমাহীন অনিয়ম দুর্ণীতি, সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত, স্বাস্থ্য ও সংস্থাপন বিভাগের অব্যবস্থাপনা ও অস্বচ্ছতার সাথে যুক্ত স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবে মুখ থুবরে পড়েছে নির্মানাধীন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ প্রকল্পটি। কাজের মেয়াদে দীর্ঘসূত্রিতায় নির্ধারিত প্রারম্ভিক প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে তিনগুনেরও বেশী। নির্মান পদ্ধতি লংঘন করায় ছাদ ধ্বসে শ্রমিকের মৃত্যু। অনিশ্চিত এই প্রকল্প সম্পন্নের নির্দিষ্ট সময়কাল। সময় বৃদ্ধির অনুমোদন চেয়ে একনেক সভায় উপস্থাপিত উন্নয়ন প্রস্তাবনায় সংক্ষুব্ধ একনেক সভাপতি প্রধানমন্ত্রী তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। জেলাবাসী স্বপ্নের মেডিকেল কলেজ নিয়ে হতাশ। দায় সংশ্লিষ্টরা দুষছেন একে অন্যকে।
প্রকল্প সূত্র জানা যায়, কুষ্টিয়াসহ আশপাশের ৫জেলার মানুষের অন্তত ২০ বছর পরের চাহিদা মাথায় রেখে একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা অনুমোদিত নকশা পরিবর্তন, দরবৃদ্ধি করে কার্যাদেশ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের সত্যতা উঠে আসে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প ‘বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ’ (আইএমইডি) পরিদর্শনের পর দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে। সেখানে প্রকল্পটির নির্মানাধীণ একাডেমিক, হাসপাতাল, ছাত্রাবাস ও আবাসিকসহ সবকটি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেই নকশা পরিবর্তনসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে প্রকল্পটির প্রায় সব ক্ষেত্রেই বেঁধে দেওয়া ব্যয়ের সীমা লঙ্ঘন করে অনুমোদন না নিয়েই অর্থ ব্যয় করে সরকারী ক্রয় আইনের ‘গুরুতর লঙ্ঘন’ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন কুষ্টিয়ার সহসভাপতি কারশেদ আলম বলেন, ২০১২ সালের ৩ মার্চ একনেক সভায় ২৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্পটি অনুমোদন লাভ করে। প্রকল্পটির নির্ধারিত নির্মাণকাল তিন বছর থাকলেও ৯বছর পেরিয়ে তা শেষ হয়নি। ইতোমধ্যে ৩য় বারের মতো সময় ও ব্যয় সম্প্রসারণ অনুমোদন পায়। প্রকল্প ব্যয় এখন প্রায় ৭শ’কোটি টাকা, এতেও কাটছে না প্রকল্প সম্পন্নের অনিশ্চিত অন্ধকার। সেখানে এতোবড় একটা প্রকল্প সাইডে কাজ চলছে অথচ প্রকল্প সারসংক্ষেপ সম্বলিত কোন প্রজেক্ট বোর্ড না থাকাটাও অস্বচ্ছতার একটা প্রমান। বর্তমান সরকার কুষ্টিয়া জেলায় ছোট বড় নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে; কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবের লেবাসে সব উন্নয়ন সফলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে অনিয়ম দূর্নীতির হোতারা।
নির্মাণাধীন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের ৭তলা বিশিষ্ট হাসপাতাল ভবনের ৪র্থ থেকে ৭ম তলা পর্যন্ত প্রায় ৭০কোটি টাকা নির্মানচুক্তিতে কাজ করছেন বিশ^াস ট্রেডিং কন্সট্রাকশন। সংশ্লিষ্ট এই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সাইট ইঞ্জিনিয়ার সিবেশ^র মালো বলেন, আমরা নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে পারব না, কারন সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত বিভাগের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সময়মতো ড্রয়িং, ডিজাইনসহ আনুষঙ্গিক নির্দেশনা দিতে অধিকাংশ সময়ই বিলম্ব করেন, এতে কাজের গতিও অনেকটা ঝুলে যায় এবং বার বার প্রকল্প রিভাইজের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। উনারাই বলতে পারবেন কেন এমন হচ্ছে ?
নির্ধারিত নকশা পরিবর্তন, নির্মান পদ্ধতি লংঘন করে সঠিক উপকরণ ব্যবহার না করায় ছাদ ধ্বসে শ্রমিকের মুত্যু, বার বার দর বাড়িয়ে কার্যাদেশ আদায়সহ নানা অনিয়মে অভিযুক্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান টি ই এ এল-জহিরুল লি: প্রকল্প দুর্ঘটনার দায়ে কালো তালিকাভুক্ত হয়। অথচা এখনও বহাল আছেন সেই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত সাইট ইঞ্জিনিয়ার সবুজ বলেন, আমরা ১লক্ষ ৪০হাজার বর্গফুট বিশিষ্ট মুল হাসপাতাল ভবনের ১ম থেকে ৩য় তলা পর্যন্ত নির্মানকাজ অনেক আগেই শেষ করেছি। এখন ওইসব ফ্লোরগুলিতে নির্ধারিত অবকাঠামোর দেয়াল নির্মানসহ প্লাষ্টারের কাজ চলছে। এই কাজটি এখনও অনুমোদন হয়নি। ১ম থেকে ৩য় তলা পর্যন্ত যে হাসপাতাল ভবন নির্মাণ অনেক আগেই শেষ হয়েছে সেখানে এখনকার চলমান কাজ কেন পাস হয় নাই এমন প্রশ্নের জবাবে সবুজ জানান ‘এসব কিছু আমি বলতে পারব না, আমার ঠিকাদার জহুরুল সাহেব এবং গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।
কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, নির্মাণকালের নির্ধারিত সময় পার করে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে দেয়া কুষ্টিয়া বাসীর স্বপ্নের মেডিকেল কলেজ নির্মান প্রকল্পটি যাদের কারণে বার বার এমন অনিশ্চিতের হোচট খাচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি করছি। সেই সাথে অবিলম্বে এই প্রকল্পটির নির্মান সম্পন্ন করে সিমাহীন কষ্টে থাকা শিক্ষার্থীদের আপন ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেয়ার আবেদন করছি।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা: সরোয়ার জাহান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আশ্বাসের বানী শুনে কেটে গেছে ৯টি বছর। এখন আমাদের ৯ম ব্যাস চলছে। ইতোমধ্যে ৪টি ব্যাস এখান থেকে বেড়িয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য সেবায় যোগদান করেছেন। জোড়াতালি দিয়ে কোন রকম চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষাদান করতে শিক্ষক এবং শিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীরা নানাবিধ সমস্যার মধ্যে আছে। অস্বাস্থ্যকর, পরিত্যক্ত ও জড়াজীর্ণ আবাসনের সংকটে থাকা শিক্ষার্থীরা যেমন ঝুঁকিপূর্ন জীবন-যাপন করছে একই ভাবে তাদের শিক্ষাদানসহ একাডেমিক কার্যক্রমে প্রাসঙ্গিক আয়োজন সংকুলান করতে পারছি না আমরা। বিদ্যমান পরিস্থিতির দ্রæত সমাধান দাবি করেন তিনি।
তবে এবিষয়ে অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীণতার সকল অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম গণমাধ্যমে সামনে কোন রকম মুখ খোলেননি। তিনি নিরুপায় ও ক্যামেরার সামনে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট তিনটি বিভাগের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের উপর দায় চাপালেন।