
কুষ্টিয়াসহ বন্ধ ঘোষিত দেশের ৬টি চিনিকল চালুর দাবিতে বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রঘোষিত ঝটিকা সফর ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রবিবার বেলা ১১টায় কুষ্টিয়া চিনিকল সংলগ্ন মিল বাজারে সিপিবি কুষ্টিয়া জেলার সাধারণ সম্প্দাক হেলাল উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুল্লাহ আল কাফী, বজলুর রশীদ ফিরোজসহ জোটের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এসময় নেতৃবৃন্দ বলেন, খোঁড়া অজুহাতে রাষ্ট্রীয় চিনিকল বন্ধ বা বেসরকারীকরণ নয় বরং আধুনিকায়ণ করতে হবে। সেই সাথে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ও আঁখ চাষীদের আঁখের মূল্য পরিশোধ করে হয়রানি বন্ধ করতে হবে। লোকসানের জন্য দায়ী নীতি নির্ধারক দুর্ণীতিবাজ আমলাদের গ্রেফতার ও বিচার করে দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে বন্ধের অপেক্ষামান রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠান রক্ষায় চিনিকলের জমি, সম্পদ লুটপাটের ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়ান।
নেতৃবৃন্দ বলেন, দেশের প্রধান কৃষিভিত্তিক ভারি শিল্প চিনিকলগুলো বন্ধের পাঁয়তারা চলছে। একদিকে মহাসমারোহে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর ঢাক পেটানো হচ্ছে, অন্যদিকে অর্থনীতির স্থায়ী ভিত্তিগুলোকে একে একে ধ্বংস করার সব আয়োজন সম্পন্ন করছে সরকার। স্বাধীনতার সাথে সাথে বাংলাদেশ পেয়েছিল পাটকল, চিনিকল, চা এবং চামড়া শিল্প। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যেই এর সবগুলো ব্যক্তিখাতে তুলে দেয়ার কাজ শেষ করা হচ্ছে। গত ২০২০ সালের জুলাই মাসের ১ তারিখে ২৫টি রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধ করে দিয়েছে। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে ১৫টি চিনিকলের মধ্যে প্রথম দফায় কুষ্টিয়া, পাবনা, রংপুর, শ্যামপুর, সেতাবগঞ্জ ও পঞ্চগড় এই ৬টি চিনিকল বন্ধের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকার। এর ফলে বেকার হয়ে পড়বে স্থায়ী-অস্থায়ী, মিলে চিনিকলের সাথে সংশ্লিষ্ট ২৫ হাজার শ্রমিক। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৫ লাখ আখচাষি এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত ৫০ লাখ মানুষ। লোকসানী প্রতিষ্ঠান বা পুরনো অজুহাতে নতুনভাবে লুটপাট চিনিকল বন্ধের যুক্তি দেখিয়েছে সরকার। অথচ লোকসানের কারণ কি তা বলা হচ্ছে না। আমরা বলেছি লোকসানের কারণ দুর্নীতি, অব্যব¯’াপনা, অপচয়, অদক্ষতা। এর কোনটার সঙ্গেই আখচাষি, চিনিকল শ্রমিক ও দেশবাসী যুক্ত নন। একদিকে লুটপাট করে কারখানাকে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হচ্ছে অন্যদিকে লোকসানের অজুহাতে চিনিকলের ১৯ হাজার একর জমি ও ২৫ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি লুটপাটকারীদের হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে ক্ষমতাসীনরা। ফলে শ্রমিক হারাবে কাজ, জনগণ হারাবে সম্পদ আর প্রায় বিনামূল্যে রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিক হবে ক্ষমতাসীনদের অনুগ্রহপুষ্ট লুটপাটকারীরা। আধুনিকায়ন করলে চিনিকল লাভজনক করা সম্ভব দেশে চিনির চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা মাত্র ২ লাখ ১০ হাজার টন। চাহিদা পুরণে যেখানে প্রয়োজন চিনির উৎপাদন বাড়ানো। সেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে মাত্র ৮২ হাজার টন। সেকারণে রাষ্ট্রীয় চিনিকল বন্ধ নয় বরং আধুনিকায়ন করে তার চালু রাখতে হবে। লোকসানের দায় শ্রমিক-কৃষকের উপর না চাপিয়ে দুর্নীতির সাতে জড়িত মূল হোতাদের বিচার করতে হবে। দেশের ৫টি বেসরকারি চিনি পরিশোধন কারখানা বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করে তা পরিশোধন করে বাজার সয়লাব করে ফেলছে। পরিশোধন কারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলে এরা ধ্বংস করছে পরিবেশ এবং দেশকে বিদেশি চিনির উপর নির্ভরশীল করে ফেলছে। দেশের স্বার্থের কথা ভাবলে চিনিকলগুলো আধুনিকায়ন করা, চিনির উপজাত চিটাগুড়, ছোবড়া ও প্রেসমাডকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে অনেক সহায়ক শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। কাগজ, এলকোহল, জৈব সার, সানিটাইজার উৎপাদন এবং আখের ছোবড়া ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত। অথচ সেগুলি না করে জনগণের সম্পদ লুটপাট করাই এদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের স্বার্থেই রাষ্ট্রীয় সম্পদ চিনিকল রক্ষা করতে হবে। যে কোন দেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি সে দেশের ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান। অথচ একের পর এক সেই শিল্পসমূহ ব্যক্তিখাতে তুলে দিয়ে দেশের শ্রমিক কৃষক ও সাধারণ মানুষকে পুঁজিপতিদের কাছে জিম্মি করে ফেলা হচ্ছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত কৃষিভিত্তিক ভারী শিল্প আমরা লুটপাটকারীদের হাতে বিনা প্রতিরোধে ছেড়ে দিতে পারি না। বাম গণতান্ত্রিক জোট তাই দেশের সম্পদ লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেশবাসীর প্রতি আহবান জানিয়ে চিনিকল এলাকাসমূহে ১০ থেকে ১২ জানুয়ারি ২০২১ সফর কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। কুষ্টিয়া থেকে শুরু হয়ে এই সফর ঈশ^রদীলালপুর-নাটোর-জয়পুরহাট-মহিমাগঞ্জ-শ্যামপুর-সেতাবগঞ্জ-ঠাকুরগাঁও হয়ে পঞ্চগড়ে গিয়ে শেষ হবে। এই কর্মসূচি সফল করুন চিনিকল, আখচাষি ও চিনিকল-শ্রমিকসহ জনগণের সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে এগিয়ে আসুন এবং আওয়াজ তুলুনÑ লোকসানের জন্য দায়ী নীতিনির্ধারক, দুর্নীতিবাজ আমলাদের গ্রেফতার ও শাস্তি দাও। শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ও কৃষকের আখের মূল্য পরিশোধ কর। চিনি শিল্পের বহুমুখীকরণের পদক্ষেপ নাও। উন্নত জাতের আখ উদ্ভাবনে বৈজ্ঞানিক গবেষণা বৃদ্ধি করো। আখ চাষিদের ন্যায্যমূল্যে সার, কীটনাশক সরবরাহ কর।
এ সময় আরও বক্তব্য রাখেন, ইউনাইটেড কমিউনিষ্ট লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য নজরুল ইসলাম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য আনসার আলী, গনতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি কেন্দ্রীয় সদস্য শহিদুল ইসলাম সবুজ, গণসংহতি আন্দোলনের নেতা দীপক কুমার রায়, শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য ভজন বিশ্বাস, বাসদ কুষ্টিয়া জেলা সমন্বয়ক কমরেড শফিউর রহমান শফি এবং অনুষ্ঠা পরিচালনা করেন বাসদ নেতা আশরাফুল ইসলাম।