
আজ ১৭ ই এপ্রিল । দিনটি স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরনীয় দিন। ৪০ বছর আগে এই দিনে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ নিয়েছিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার এক আমবাগানে । আর সেদিন থেকে ঐ জায়গার নাম বদলে রাখা হয় মুজিবনগর। প্রবাসী অস্থায়ী সরকারের রাজধানী। একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলো প্রতিরোধ চলছে সর্বত্র । এর মধ্যে ১৭ এপ্রিল গঠন করা হয় প্রবাসী সরকার । মুজিবনগর সরকারই দীর্ঘ ৯ মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে । পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে । মুজিবনগর তাই বাঙ্গালীর ইতিহাসে প্রজন্ম-প্রজমান্তরের এক অ¤øান স্মৃতি । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নামেই মুজিবনগরের নামকরণ। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুজিরনগরকে নতুন প্রজন্ম ও পর্যটকদের নিকট আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য একটি কমপ্লেক্স গড়ে তোলার কর্মসূচী নেয়। এই কমপ্লেক্সের কাজ বাস্তবায়নের জন্য ৩০ একর জমির উপর মুজিবনগর কমপ্লেক্স স্থাপন প্রকল্পের কাজ হয়।
“সেদিনের স্মৃতি”
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল দিনটি ছিল শনিবার । বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহনের ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। পাক বাহিনীর বিমান হামলার আশংকায় এই গোপনীয়তা । শুধুমাত্র তখন কলকাতায় প্রেসক্লাবে হাজির থাকতে বলা হয়। সকাল ৬টার মধ্যেই কলকাতা প্রেসক্লাবে কয়েকশ বিদেশী ও ভারতীয় সাংবাদিক এবং টিভি ক্যামেরাম্যান ভিড় জমায়। বাংলাদেশের পক্ষে একজন কর্মকর্তা প্রেসক্লাবে হাজির হয়ে সাংবাদিকদের স্বাগত জানান। তিনি সাংবাদিকদের আগাম কোন কিছু না জানিয়ে শুধুমাত্র তাদের গাড়ি অনুসরন করতে অনুরোধ করেন।
সাংবাদিকগন তখনও জানেন না, তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক দুলর্ভ ঘটনার সংবাদ কভার করতে যাচ্ছে। কলকাতা শহর পার হয়ে গাড়ির বহর কৃষ্ণনগর শহর অভিমুখে রওনা হয়। তারপর কৃষ্ণনগর পার হয়ে বাংলাদেশের সীমাস্তের দিকে আগাইতে থাকে । দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গাড়ির বহর আঁকাবাঁকা কাঁচা পথ ধরে বাংলাদেশের ভিতর প্রবেশ করে। এক সংগে মেটো পথে এত গাড়ি চলায় চারিদিক ধূলায় আচ্ছাদিত হয়ে যায়। সবাই হাজির হলেন তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলার বিশাল আমবাগানে । এককালের এক হিন্দু জমিদারের এই আমবাগানের নতুন নাম করণ করা হয় মুজিবনগর। সকাল হতে বিশাল ছায়াবন আমবাগানে উৎসুক জনতার ভিড়। খালি গায়ে ছেলেরা বসে আসে আমবাগানের ডালে ডালে। কিন্ত কেউই জানে না, তারা কোন ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য অর্জন করতে যাচ্ছেন। সেখানে পৌছে সবাই জানতে পারলেন বিষয়টি।
১৯৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর এমনি এক আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। ঠিক এর ২১৪ বছর পর পলাশীর অদুরে আরেক আমবাগানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নতুন সূর্য উদিত হতে যাচ্ছে। আম বাগানের চারিদিকে রাইফেল হাতে কড়া প্রহরা বসিয়েছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। উৎসাহী জনতা দেখছে ঐতিহাসিক মুহুর্তটি। টিভি ক্রু ও ফটো সাংবাদিকরা মন ভরে ছবি তুলছেন। মুক্ত আকাশের নিচে চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছে শপথ মঞ্চ। মঞ্চের উপর সাজানো ৬ খানা চেয়ার । বামপাশে কয়েকখানা চেয়ার ছিল সাংবাদিকদের জন্য। অনুষ্ঠানের প্রবেশ পথে বাংলায় লেখা স্বাগতম। স্থানীয় সময় বেলা ১১টা বেজে ৫০ মিনিটে নতুন রাষ্ট্রের নেতারা এলেন জীপে চড়ে। জনতা জয়বাংলা শ্লোগান তুলে ফেটে পড়লো । মঞ্চে উঠে এলেন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম । তার পিছনে তাজউদ্দিন আহমেদ ,খন্দকার মোশতাক আহমেদ ,এ এইচ এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও জেনারেল এজি ওসমানি। আসন গ্রহণপর্ব শেষে অনুষ্ঠানসূচী ঘোষনা করলেন এম এ মান্নান । পবিত্র কোরআন তেলায়াতের মাধ্যমে মুল অনুষ্ঠান শূরু হয় । আওয়ামীলীগের সংসদীয় দলের চীফ হুইপ ইউসুফ আলি ঐতিহাসিক দলিল স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র পাঠ করেন । এর সাথে সাথে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলাম , প্রধানমন্ত্রী পদে তাজউদ্দিন আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে খন্দকার মোসতাক আহমেদ,স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে এইচ এম কামরুজ্জামান এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক্যাপ্টেন মনসুর আলির নাম ঘোষনা করেন। আর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ পদে যথাক্রমে এজি ওসমানী ও জেনারেল আব্দুর রবের নিয়োগের ঘোষনা দেয়া হলো। এরপর নতুন সরকার অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট,মন্ত্রীবর্গ ও সেনাবাহিনী প্রধানকে শপথবাক্য পাঠ করান অধ্যাপক ইউসুফ আলি । তবে এ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান উপস্থিত না থাকলেও বার বার উচ্চারিত হয় তার নাম। শপথ গ্রহনের পর অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবর্গকে একদল মুক্তিযোদ্ধা আনসার তেজোদ্দীপ্ত ভঙ্গীতে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা যা কিছু করেছি সবই মুজিবের নির্দেশে। এ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন মেহেরপুরের মরহুম অধ্যাপক আসাদুল হক ,পিন্টু বিশ্বাস ,শাহাবদ্দিন সেন্টু প্রমুখ। এ অনুষ্ঠান থেকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ও প্রধান মন্ত্রী বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের কুটনৈতিক স্বীকৃতি দান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান। বাংলাদেশের ১৬৯ জন জাতীয় সংসদ সদস্যের মধ্যে ১৬৭ জন উপস্থিত ছিলেন। আনুষ্ঠানিক সরকার গঠনের পর সকলেই ভারতে চলে যান।
মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামোর নানা সমস্যা
ঐতিহাসিক মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স প্রকল্প ১০০ ভাগ নির্মান কাজ আজও সম্পূর্ন হয়নি । ভৌত অবকাঠামোর নানা সমস্যা রয়ে গেছে। এছাড়া স্বাধীনতার সূতিকাগার মেহেরপুর জেলার মুজিব নগর বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী হলেও রাষ্ট্রিয়ভাবে ১৭ এপ্রিল মুজিব নগর দিবসের মর্যাদা পাইনি । এ দিন সরকারী ছুটি ঘোষনা করা হয়না। ছুটি না থাকায় বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র/ছাত্রী ও শিক্ষকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে মুজিবনগর দিবসে মুজিবনগরের অনুষ্ঠানে যোগদান করাতে পারেনা।
১৯৭১সাল থেকে ১৯৯১সাল পর্যান্ত ২০ বছর মুজিবনগর ছিল অবহেলিত। ১৯৯১ সালে এরশাদ সরকার ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মান করে মুজিবনগর সৌতিসৌধ ,রেস্ট হাউজ ,তোরন এবং মুজিবনগর পাঠাগার ও ক্লাব । আওয়ামীলীগ সরকার মুজিবনগরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে ৩০ একর জমির উপর শুরু করে মুজিবনগর কমপ্লেক্স স্থাপনের কাজ । তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নকশা তৈরিতে শম্ভকগতি, আর্থিক সংকটসহ বিভিন্ন কারনে আজও শেষ হয়নি মুজিবনগরকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কাজ ।
মুজিবনগর কমপ্লেক্স স্থাপন প্রকল্পের শুরুটা ছিল নানা সমস্যা জর্জরিত। প্রকল্পের অন্যতম ক্রটি ছিল নকশা ছাড়া একনেকে প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া । বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নকশা তৈরির কাজ করে। বাংলাদেশের মানচিত্রের কাজ ২০০৫ সালের শেষের দিকে শুরু হয়ে ২০০৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০১০ সালের জুন মাসে শেষ হয়েছে। মুজিবনগর কমপ্লেক্সের স্থাপন প্রকল্পের কাজে স্থানীয় সরকার , ডাক ও টেলিযোগাযোগ গৃহায়ন ও গনপূর্ত ,পরিবেশ ও বন সমাজ কল্যাণ, ধর্ম ,স্বরাষ্ট্র এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ ১১টি মন্ত্রণালয় অর্থ বরাদ্দ দিলেও মুল তত্ত¡াবধানে রয়েছে গনপূর্ত মন্ত্রণালয়। মুল স্মৃতিসৌধ অযতœ অবহেলায় পড়ে থাকে , যেন দেখার কেউ নেই।
এছাড়া উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা, চেয়ারম্যান , ননগেজেটেড কোয়াটার ,ডরমেটরি ভবন , অভান্তরিন সডক ,সংযোগ সডক, শিশু পরিবার ,ডিজিটাল টেলিফোন একচেঞ্জ, মসজিদ, ডাকঘর নির্মানের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। সূত্র মতে ২০০২ সালের ১৫ এপ্রিল মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র নির্মান প্রকল্পের পিপি কাটছাট করে মুল নকশায় বাংলাদেশের মানচিত্রে টান্সমিশন সেন্টারের সামনে স্বাধীনতার ঘোষনা পত্র পাথরের অথবা টাইলসের ফলকে স্থাপন ,মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি জাদুঘরের প্রবেশ পথ থেকে কক্ষের অভান্তরের বিপরীত দিকে দৃর্শমান তৎকালীন প্রবাসী সরকারের সকল সদস্যের ছবি ,বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত বই বিক্রি কেন্দ্র ও ৫ হাজার গ্রন্থ সংরক্ষনের জন্য গ্রন্থাগার “বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর” ¯েøাগান সংবলিত স্তম্ভ এবং স্তম্ভের উর্দ্ধে উচিয়ে ধরা রাইফেলের নলে বাধা স্বাধীন বাংলার পতাকার ভাস্কর্য স্থাপন করার হয়। এই ভাস্কর্য ৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে উপস্থিত সকল ছাত্র নেতার প্রতিচ্ছবি থাকবে । মুজিবনগর কমপ্লেক্সের ভেতরে জাতীয় পাখি দোয়েল , জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার ,জাতীয় মাছ ইলিশ ,জাতীয় ফুল শাপলা ,জাতীয় ফল কাঠালের ভাস্কর্য স্থাপনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে । গনপূর্ত বিভাগের নিবাহী প্রকৌশলী বলেন ,১৯৯৮ সালে শুরু হওয়া মুজিবনগর কমপ্লেক্সের পুরো কাজ সময়মত অর্থ বরাদ্দ পেলে দ্রæত কাজ শেষ করা সম্ভব।